আজ, সোমবার | ৩১শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | সন্ধ্যা ৭:৫৩


ঈদ আসে স্বমহিমায়

অনন্যা হক : কই, বাজারের ব্যাগ দাও, আব্বা সকালে নাস্তা সেরে রান্না ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আম্মা ব্যাগ এনে কি কি লাগবে তার লম্বা এক তালিকা দিলো। পেঁয়াজ, রসুন আদা,গরম মশল্লা, কিশমিশ, সেমাই ঘি, পোলাও এর চাল, মাংস ইত্যাদি।এভাবেই শুরু হতো বাড়িতে ঈদ আয়োজন।

এলাকা জুড়ে নিজেরা আত্মীয়স্বজন। আরো আছে আশেপাশে প্রতিবেশী, বন্ধুদের বাড়ি। বাড়িগুলো সব গায়ে গায়ে লাগানো। এক বাড়ি থেকে আর এক বাড়ির মানুষের কথা, হাসি, হাঁকডাক সব শোনা যায়। চারিদিকে জমজমাট পরিবেশে জাঁকজমকপূর্ণ ঈদের আয়োজন শুরু হলো। এক মাস রোজার পর বিকেল থেকে সবার মধ্যে আগামীকাল না পরশু ঈদ, সৌদি আরবে চাঁদ দেখা গেল কিনা এসব নিয়ে টানটান উত্তেজনা উৎকন্ঠা।সৌদি আরবে চাঁদ দেখা গেলে তার একদিন পরে আমাদের ঈদ। তবুও ঈদের চাঁদ দেখে তবে শান্তি।

দল বেঁধে কলেজের মাঠে কেউবা বাড়ির ছাদে গিয়ে চাঁদ দেখার চেষ্টা।এরপর কাস্তের মতো এক ফালি চাঁদ যদি সত্যি আকাশের কোন কোণে দেখা গেল তো সমস্বরে চিৎকার কিংবা পটকা ফোটার আওয়াজ। পুরো এলাকার মানুষের আনন্দ টের পাওয়া যেতো ঘরে বসেও।

তারপর সেই সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে গেল ঈদের আনন্দ,শহরময় সাজ সাজ রব। আমরা যারা ছোট সকল নিয়ম রুটিন এর উর্ধ্বে গিয়ে ইচ্ছে মতো এ বাড়ি ও বাড়ি চষে বেড়ানো,লাগামহীন আড্ডা হাসিখুশি আমেজে পাড়া সরগরম।

টেলিভিশন তখন এক মাত্র বিনোদন সামগ্রী, ঈদ উপলক্ষে কি কি অনুষ্ঠান, নাটক হানিফ সংকেতের ইত্যাদি কখন,সবাই তটস্থ সজাগ।কিচ্ছু মিস করা যাবে না। এক অনাবিল আনন্দ ছিল সার্বিক ভাবে ঈদকে ঘিরে।

ঈদের নতুন কাপড়ের গন্ধ যেন আলাদা, আকর্ষণও তাই। কত যত্ন করে তুলে রাখা, কাউকে দেখানো যাবে না, এক পোশাক ঘিরেই কত আনন্দ। এমন অসংখ্য ছোট ছোট বিষয় ঘিরে ঈদকে নিয়ে আমাদের মনে ছিল কত আহ্লাদ কত সুখ।

আমাদের এলাকায় লাগোয়া বাড়িগুলোতে আমরাই আত্মীয় পরিজন নিয়ে অনেক মানুষ অনেক ভাই বোন। তখন মাথার উপর মুরব্বিদের সংখ্যা ছিল অনেক।একে একে চলে গেছেন অনেকেই। নানা নানি,দাদা দাদি আব্বা চাচা ফুফু ফুফা,খালা,মামা এমন কত কাছের মানুষ। আমরা একই এলাকায় অনেক কাছাকাছি তাঁদের স্নেহ মমতায় জড়িয়ে পেঁচিয়ে বড় হয়েছি।

ঈদের সময় আমাদের অভিভাবকেরাও অন্য রকম আমেজে থাকতেন।তাদের প্রকাশটা আমাদের মতো না হলেও সবাই খুশি, প্রাণবন্ত অতিথিপরায়ণ।যখন তখন যে কেউ চলে আসা তাদেরকে আপ্যায়ন এসবই ছিল অত্যন্ত খুশির সাথে এক রীতি। মা খালা ফুফু চাচিদের সারাদিন ব্যস্ততার পর পরণে নতুন শাড়ি,পুরুষদের পরণে নতুন পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবি ঈদের এক বিশেষ পোশাক।ঈদের সময় কেনাকাটার হিড়িক পড়ে যায় বলে শহরে মার্কেটগুলোও এক নতুনত্বে সেজে ওঠে।

বাজারঘাট থেকে শুরু করে কোটাবাছা, রান্না বান্না,খাওয়া দাওয়া,ঘোরাঘুরি সব কিছু এক অন্য রকম খুশি যা আর কোনো পার্বণে ঈদের মতো এতটা হয় না।

আগের দিন সন্ধ্যায় ইফতারির পরেই, শুরু হতো মা চাচিদের আয়োজনে কোটাবাছা বাটনা বাটা।তাদের কাজের তদারকি, কথাবার্তা আমাদের মনের মধ্যে এক অন্যরকম ভালো লাগা এনে দিতো।পরদিন সকাল শুরু হতো ভোর থেকে রান্নার তোড়জোড়।

বড় কড়াইয়ে দুধ জাল হচ্ছে,পাশে ঘিয়ে ভাজা সেমাই, কিশমিশ তেজপাতা,গরম মশলা।ঈদের সকালের বিশেষ আয়োজন দুধ সেমাই, জর্দা সেমাই।ঘিয়ে ভাজা সেমাই এর গন্ধে বাড়ি মৌ মৌ।

সেমাই ছাড়া ঈদ অকল্পনীয় তখন, এখনও।

বড় বড় একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে ভেঙে ছোট ছোট একক পরিবার হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছে বিভিন্ন শহরে।

জীবনের বাস্তবতার তাগিদে এমনটাই স্বাভাবিক।এখন তাই অনেকের ঈদ একা করতে হয়,অনেক পরিবার আবার ছুটে চলে যায় দেশের বাড়িতে আত্মীয় পরিজনসহ ঈদ উদযাপন করতে।

আগের মতো না হলেও ঈদ ঈদই।ঈদের আনন্দকে আমরা কখনও উপেক্ষা করতে পারি না।ঈদ আমাদের বিশেষ ঐতিহ্যবাহী পার্বণ,এক ধর্মীয় অনুষ্ঠান যা সেই আদি কাল থেকে মজ্জাগত হয়ে আছে।

একক পরিবারে ঈদ পালন করলেও আয়োজনে কোন অংশে কমতি করতে পারি না আমরা।তাই তো এখনও ঈদ আসলে রোজা থেকেই শুরু হয় মনে মন এক উৎসব আমেজ।

ঈদ আসলে মনে পড়ে সব পুরোনো কথা, মনে পড়ে অনেক বেশি করে সব হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর কথা।মনে পড়ে ভাই বোন বন্ধু প্রতিবেশী মিলে সেই আনন্দের হাট।শহরের পথঘাট আঙিনা জুড়ে মানুষের চলাফেরা,সব ধরনের জটিলতার উর্ধ্বে গিয়ে মানুষের অপার আন্তরিকতার সেই সব স্মৃতি,যা এখন অনেকটাই ম্লান।

তবুও ঈদ আসে স্বমহিমায়।যুগ যুগ ধরে এই ধর্মীয় পার্বণের মাধ্যমে মানুষ আপন মনেই এক উৎসবমুখর পরিবেশে মানুষের সাথে হৃদ্যতার বন্ধনে মিলিত হয়।

আমাদের জীবনে ঈদের গুরুত্ব অপরিসীম। সকলের জীবনে ঈদ হোক আনন্দময়!!
অনন্যা হক: কবি ও লেখিকা।

শেয়ার করুন...




©All rights reserved Magura Protidin. 2018-2022
IT & Technical Support : BS Technology